কিডনির সমস্যা হলে কিভাবে বুঝব?

কিডনির সমস্যাঃ লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার ও করণীয়

কিডনির সমস্যা হলে শরীরে নানা রকম লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, যা প্রথমে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। সাধারণত কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে প্রস্রাবের আমূল পরিবর্তন,  যেমন বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যাওয়া অথবা প্রস্রাবে ফেনা ও দূর্গন্ধ দেখা দেওয়া। 

মাঝে মাঝে প্রস্রাবের সাথে রক্তও যেতে পারে, যা কিডনির প্রদাহ বা পাথরের লক্ষণের ইঙ্গিত হতে পারে।

কিডনির-সমস্যা-হলে- কিভাবে-বুঝব

কিডনি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে শরীরে পানি জমা হতে পারে, যার ফলে মুখ, চোখ এবং পা ফুলতে শুরু করে। এ ছাড়াও সারাদিন দুর্বলতা, ক্লান্তি ভাব, মাথা ঘোরা দেখা দিতে পারে। 

যখন কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়, তখন শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমা হতে শুরু করে, যার ফলে ত্বকে চুলকানি, শুষ্কতা অথবা বমি বমি ভাব সৃষ্টি করতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ বাড়লে সেটাও কিডনি সমস্যার সূচনা নির্দেশ করতে পারে, কারণ কিডনি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক সময় খাওয়ার রুচি কমে যায়, মুখে অস্বাভাবিক স্বাদ আসে এবং নিঃশ্বাসে বাজে গন্ধ দেখা দেয়া শুরু হয়। 

এর পাশাপাশি, রাতে ঘুমাতে সমস্যা হওয়া, পেশীতে টান ধরা, অথবা বুকে ব্যথা অনুভব করাও কিডনি সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

কিডনির সমস্যার সঠিক নির্ণয়ের জন্য রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা, ইউরিন টেস্ট এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত। উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সূচিপত্র

কি কি কারনে কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়?

কিডনি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটি রক্তকে পরিষ্কার করে এবং শরীরের বর্জ্য উপাদানগুলোকে মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেয়।

কিন্তু বিভিন্ন কারণে কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে।

ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস হল সকল রোগের মা বা জননী। ডায়াবেটিস মূলত কিডনির সমস্যার একটি  গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যখন রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করে, তখন তা কিডনির রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে। 

বিশেষ করে কিডনির ফিল্টারিং ইউনিট, গ্লোমেরুলির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। এই কারণে কিডনি সঠিকভাবে রক্ত পরিশোধন করতে পারে না । 

যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে কিডনির কার্যক্ষমতা আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত কিডনি বিকলও হয়ে যেতে পারে। 

তাই নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা ও তার যথাযথ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। 

উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার) 

উচ্চ রক্তচাপও কিডনির ক্ষতির কারণ হতে পারে। রক্তচাপ বাড়লে এটি কিডনির ভেতরের ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। 

ফলে এই নালীগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সঠিক রক্ত সঞ্চালন না হলে কিডনি তার কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে পারে না। 

তাই নিয়মিত রক্তচাপ মাপা এবং তাই উচ্চ রক্তচাপ  নিয়ন্ত্রণে রাখা কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার

অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক ওষুধ যেমন আইবুপ্রোফেন বা ফেন্টানাইল ব্যবহার করেন। এই ওষুধগুলো কিডনির রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কিডনির টিস্যুর ক্ষতি করে। 

যারা নিয়মিত এসব ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন, বিশেষ করে বয়স্ক বা ডায়াবেটিস রোগীরা, তাদের কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। 

এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ দীর্ঘদিন গ্রহন করা উচিত নয়।

জন্মগত বা জিনগত সমস্যা

কিছু মানুষের জন্মগতভাবে কিডনির সমস্যা থাকে, যেমন পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ। এই রোগে কিডনির ভিতর অনেকগুলো ফোঁটার মতো সিস্ট তৈরি হয়, যা কিডনির আকার বৃদ্ধি করে এবং কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। 

ই জিনগত সমস্যা আস্তে আস্তে কিডনিকে অকার্যকর করে তোলে এবং অনেক সময় ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পর্যন্ত হতে পারে। 

পরিবারের মধ্যে কারও যদি এটি থেকে থাকে, তবে আগেভাগে সতর্ক এবং পরীক্ষা করানো উচিত। 

ইনফেকশন বা সংক্রমণ

কিডনিতে ইনফেকশন, যেমন এমফাইসেমেটাস পাইলোনেফ্রাইটিস বা বারবার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI), যেটি কিডনির টিস্যু নষ্ট করতে পারে। 

ইনফেকশনের কারণে কিডনি ফুলে যায়, ব্যথা অনুভূত হতে পারে এবং প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা রক্ত দেখা দিতে পারে। 

দি এই ইনফেকশন বারবার দেখা দেয় এবং চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে কিডনি আস্তে আস্তে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই প্রস্রাবের যেকোনো সমস্যা অবহেলা না করে চিকিৎসার প্রয়োজন। 

পানি কম পান করা ও প্রস্রাব চেপে রাখা

শরীরে পানির অভাব হলে কিডনির বর্জ্য পরিষ্কারের কাজে ব্যাঘাত ঘটে এবং কিডনিতে পাথর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাতে পারে। 

একইভাবে, দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব আটকে রাখলে মূত্রনালীতে চাপ পড়ে এবং ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়, যা কিডনির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। 

এসব কারণে কিডনি আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়ে। প্রতিদিন অন্তত ২-৩ লিটার পানি পান করা এবং প্রস্রাব চেপে না রাখা কিডনি সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ কী কী?

ক্রিয়েটিনিন (Creatinine) হল একটি বর্জ্য পদার্থ, যা আমাদের শরীরের পেশির কার্যক্রমের ফলে তৈরি হয় এবং কিডনির মাধ্যমে মূত্রের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

যখন কিডনির কার্যক্ষমতা কমতে থাকে, তখন রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যা কিডনি সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।

এখানে ক্রিয়েটিনিনের বাড়তি মাত্রা দেখা দেওয়ার কিছু সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলোঃ

১. অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতাঃ যখন রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন শরীরে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ জমা হতে  লাগে। এই পরিস্থিতি আস্তে আস্তে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে রোগী ক্লান্তি অনুভব করে এবং সামান্য কাজ করলেই দুর্বল ভাব বোধ করে। মাঝে মধ্যে মাথা ঘোরা, অলসতা ভাব এবং ঘুম ঘুম ভাব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে পেশির শক্তি কমতে শুরু করে, যা দৈনন্দিন জীবনকে বিষাদে পরিণত করে। এটি কিডনির অকার্যকারিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ  লক্ষণ। 

২. মুখ ও চোখের নিচে ফোলা ভাবঃ ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ শরীরে অতিরিক্ত পানি জমা করতে পারে, কারণ কিডনি সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন করতে পারে না। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে চোখের নিচে এবং মুখে ফোলাভাব দেখা দেয়। সকালে ঘুম থেকে উঠলে চোখের চারপাশ ফুলে থাকতে দেখা যায় এবং পায়ে আঙ্গলের  চাপ দিলে দাগ পড়ে, যা এডিমা (Edema) হিসেবে পরিচিত। এই লক্ষণটি কিডনি সমস্যার আগাম সংকেত, যা উপেক্ষা করা উচিত নয়। 

৩. প্রস্রাবে সমস্যাঃ ক্রিয়েটিনিনের উচ্চ মাত্রা প্রস্রাবের স্বাভাবিকতাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিছু রোগী দিনে কম প্রস্রাব করেন অথবা কখনও কখনও একেবারে প্রস্রাব নাও হতে পারে। অন্যদিকে, কিছু রোগীর প্রস্রাবে ফেনা দেখা যেতে পারে, যা শরীরে প্রোটিনের ক্ষতির ইঙ্গিত বহন করে। মাঝে মাঝে প্রস্রাবে রক্ত দেখা দিতে পারে এবং প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়ার অনুভূতি হতে পারে। এসব সমস্যা কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ, যা দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।

৪. অরুচি  ও বমি বমি ভাবঃ যখন কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন শরীরে জমে থাকা বর্জ্য পদার্থ পাকস্থলীতে প্রবেশ করতে শুরু করে দেয় , যা হজমের জন্য মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে।যার ফলে খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায়, এমনকি পছন্দের খাবারও খেতে ইচ্ছা করে না। অনেক সময় খালি পেটেও বমি বমি ভাব অনুভূত হতে পারে। দীর্ঘ সময় এই সমস্যা চলতে থাকলে ওজন কমে যেতে পারে এবং শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়, যা শরীরের দুর্বলতা বাড়ায়। 

কিডনির ব্যথা কোথায় হয়

কিডনির ব্যথা সাধারণত শরীরের পেছনের অংশে, বিশেষ করে কোমরের নিচে এবং পিঠের দু’পাশে ব্যথা অনুভূত হয়। কারণ কিডনিগুলো শরীরের পেছনে, মেরুদন্ডের দুই পাশে থাকে। তাই যখন কিডনিতে সমস্যা হয়, তখন ওই জায়গাগুলোতে ব্যথা হতে দেখা যায় । 

এই ব্যথা বাম বা ডান পাশে হতে পারে, তবে সাধারণত একপাশেই বেশি অনুভূত হয়। কিডনির ব্যথার পেছনে কারণ হতে পারে  কিডনি পাথর (কিডনি স্টোন), সংক্রমণ অথবা কিডনির মারাত্মক প্রদাহ। যদি পাথর হয়ে থাকে, তাহলে ব্যথা খুবই তীব্র এবং জ্বালা অনুভুত হতে পারে, যা মাঝে মাঝে কোমর থেকে পেটের দিকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ।  

কিডনির সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যথার সঙ্গে জ্বর, অতিরিক্ত গরম লাগা এবং প্রস্রাবে সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা পূর্বে কখনও ঘটেনি। সাধারণত কিডনির ব্যথার স্থান পিঠের নিচের দিকে, কোমরের একটু উপরে এবং পিঠের মাঝখানের কাছে বেশি ব্যথা অনুভুত হয় ।  

কখনো কখনো এ ব্যথা শরীরের সামনের দিকে বা পেটের পাশেও অনুভূত হতে পারে, তবে প্রধানত পিঠে বেশি থাকে। যদি ব্যথার সঙ্গে প্রস্রাবের সময় জ্বালা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া , উচ্চ তাপমাত্রা অনুভব অথবা ঠাণ্ডা লাগার মতো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো অতীব জরুরি। কারণ কিডনির সমস্যা দ্রুত চিকিৎসা না হলে গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে।  

কিভাবে কিডনি ভালো রাখা যায়?

কিডনিকে সুস্থ রাখা আমাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ এবং অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়।

সুস্থ কিডনির জন্য কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর নিয়ম পালন করা প্রয়োজন।

  • কিডনি সুস্থ রাখতে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে, তা হলো পর্যাপ্ত পানি পান করা। প্রতিদিন অন্তত পক্ষে  আট থেকে দশ গ্লাস পানি পান করলে শরীরের ক্ষতিকারক উপাদানগুলো বের হয়ে যায় এবং কিডনির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। পানি কম খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়  এতে করে নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই নিয়মিত পানি পান করা খুবই জরুরি। 
  • পানি আমাদের শরীরের তরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণও কিডনির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত তেল জাতীয়, মশলা এবং লবণযুক্ত খাবার কম খাওয়া প্রয়োজন , কারণ এগুলো কিডনির ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ফল ও সবজি জাতীয় খাবার নিয়মিত খেলে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ পায়, যা কিডনির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক। 
  • চিনি কম খাওয়া শরীরের জন্য উপকার , কারণ বেশি চিনি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, যা কিডনি রোগের একটি প্রধান কারণ। নিয়মিত ব্যায়াম কিডনির স্বাস্থ্য ভালো রাখে । ব্যায়ামের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয় এবং শরীর থেকে বিষাক্ত টক্সিন গুলো বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে । অতিরিক্ত ওজন কিডনির ওপর চাপ বাড়ায়, যা বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা উচিত।             

এছাড়া, ধূমপান এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলো কিডনির জন্য ক্ষতিকর এবং  বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যারা ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের নিয়মিত কিডনির পরীক্ষা করানো দরকার। 

কারণ এই রোগগুলো কিডনির ক্ষতি করতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা এবং শরীরের অন্যান্য সমস্যার যত্ন নেওয়া  প্রয়োজন । 

কিডনি রোগীরা কি মাছ খেতে পারবে?

কিডনি রোগীদের জন্য মাছ খাওয়া যাবে কি না, তা মূলত তাদের কিডনির স্বাস্থ্যগত অবস্থার উপর নির্ভর করে এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়।

সাধারণভাবে, কিডনি রোগ থাকলে শরীরে প্রোটিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বেশি প্রোটিন কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা রোগীর ক্ষতি করার সম্ভাবনা বাড়ায়। ওকে

মাছ একটি চমৎকার প্রোটিনের উৎস, কিন্তু কিডনি রোগীদের জন্য মাছ খাওয়ার কিছু নিয়ম মেনে চলা  উচিত। 

নিয়ম গুলো হলোঃ

  • কিডনি রোগীদের উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার, বিশেষ করে যারা ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন বা কিডনির শেষ পর্যায়ের রোগে ভুগছেন, তাদের মাছ খাওয়ার পরিমাণ সীমিত করা উচিত। কারণ অতিরিক্ত প্রোটিন শরীরে টক্সিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, যা কিডনির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে  পারে। তাই মাছের পরিমাণ কত খানি হবে তা ডাক্তারের উপর  নির্ভর করে।
  • মাছ খাওয়ার সময় লবণের পরিমাণ কম রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিডনি রোগীদের লবণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যাতে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে এবং শরীরে অতিরিক্ত পানি জমা না হয়। বেশি লবণ কিডনির জন্য ক্ষতিকর। তাজা মাছ খাওয়াই উত্তম, প্রক্রিয়াজাত বা বেশি লবণযুক্ত মাছ খাওয়া উচিত নয়।
  • মাছের মধ্যে পটাসিয়াম এবং ফসফরাসের মাত্রা লক্ষ্য করা উচিত। কিডনি সমস্যা থাকলে এই খনিজ উপাদানের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। কিছু ধরনের মাছের মধ্যে পটাসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, যা কিডনি রোগীদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর । তাই ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী মাছের প্রকার বাছাই করা উচিত। 

আদা কি কিডনির ক্ষতি করে?

আদা একটি বেশ জনপ্রিয় মসলা, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক সুবিধা নিয়ে আসতে পারে। এটি পেটের সমস্যা, প্রদাহ এবং জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে। তবে, বিশেষ করে কিডনি রোগীদের জন্য আদা খাওয়ার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হয়।

আদায় এমন কিছু উপাদান বিদ্যমান যা কিডনির ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। যদি কিডনি সুস্থ না থাকে, অর্থাৎ কিডনি্তে সমস্যা থাকে, তাহলে অতিরিক্ত আদা গ্রহণ করা কিডনির ওপর  চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কিডনির অসুস্থতার কারণে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করার ক্ষমতা  হারিয়ে ফেলে। 

আদায় থাকা অক্সালেটের মতো উপাদান বেশি পরিমাণে কিডনির পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই যাদের কিডনিতে পাথর আছে বা অতীতে পাথরের সমস্যা হয়েছিল, তাদের জন্য আদার ব্যবহার সীমিত রাখা প্রয়োজন । 

আদার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ একটি গুণ হলো এটি রক্ত পাতলা করতে সহায়ক। যদি এটি রক্তচাপের ওষুধের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। 

কিডনি রোগীরা যদি ব্লাড থিনার বা রক্ত পাতলা করার ওষুধ গ্রহণ করেন, তবে আদার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাধারণভাবে, সুস্থ কিডনির জন্য আদা খাওয়া নিরাপদ। 

কিডনি সমস্যার ক্ষেত্রে একজন ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে আলোচনা করে আদার সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা  দরকার। 

রান্নায় সামান্য পরিমাণে আদা ব্যবহার করা সাধারণত সমস্যা তৈরি করে না, তবে অতিরিক্ত আদা খাওয়া থেকে বিরত থাকায় ভালো। 

সুতরাং, আদা কিডনির জন্য ক্ষতিকর নয় যদি এটি সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করা হয়। 

লেবু কি কিডনির জন্য ক্ষতিকর?

লেবু সাধারণভাবে কিডনির জন্য ক্ষতিকারক নয়, বরং এটি অনেক উপকার এনে দেয়। লেবুর মধ্যে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের প্রচুর উপস্থিতি থাকে, যা কিডনির স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি শরীরে অতিরিক্ত অ্যাসিড জমা হতে দেয় না এবং কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায়। 

বিশেষভাবে, লেবুর রস কিডনির পাথর ভাঙার ক্ষেত্রে কার্যকর এবং নতুন পাথর তৈরির বিরুদ্ধে করে। তাই কিডনি রোগীদের জন্য লেবু গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। 

তবে, যদি কিডনিতে অ্যাসিডিটির সমস্যা থাকে বা ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে, তাহলে অতিরিক্ত লেবুর রস খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ লেবুর রস অ্যাসিডিটি, যা কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকে। 

যারা কিডনি রোগে ডায়ালাইসিসে রয়েছেন অথবা যাদের কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেছে, তাদের জন্য লেবু খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। 

সাধারণভাবে, সঠিক পরিমাণে লেবু খাওয়া কিডনির জন্য ক্ষতির কারণ নয়, বরং এটি কিডনির জন্য উপকারী হতে পারে। 

তবে, শারীরিক অবস্থার ভিত্তিতে ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত লেবুর রস বা লেবু পানি পান করলে হজমের সমস্যা বা অ্যাসিডিটির কারণ হতে পারে, তাই  সাবধানতার সহিত লেবু খাওয়া উচিত। 

কিডনির জন্য ক্ষতিকর সবজি কোনগুলো?

যাদের কিডনির সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য কিছু কিছু সবজি খাওয়া এড়িয়ে চলা অতীব জরুরী। কারণ এগুলো কিডনির উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।

নিচে কিডনির জন্য ক্ষতিকর কিছু সবজির নাম এবং তাদের ক্ষতির কারণগুলো পয়েন্ট আকারে দেয়া হলোঃ

পালং শাক (Spinach)

পালং শাকের মধ্যে অক্সালেটের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, যা কিডনিতে পাথর হওয়ার  ঝুঁকি বাড়ায়। কিডনি দুর্বল হলে অক্সালেট জমা হতে শুরু করে, যা কিডনির জন্য ক্ষতির কারণ। সুতরাং, কিডনি রোগীদের পালং শাক খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের মাত্রা সীমিত রাখতে হবে। পালং শাক ভালোভাবে রান্না করলে কিছুটা অক্সালেট কমে যায়, তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া বিপজ্জনক। 

বাঁধাকপি (Cabbage)

বাঁধাকপিতে পটাসিয়াম ও ফসফরাসের উপস্থিতি বেশি পরিমাণে থাকে, যা কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে পারে। কিডনি রোগীদের সাধারণত এই খনিজগুলোর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। অতিরিক্ত পটাসিয়াম কিডনির কার্যকারিতার ক্ষেত্রে   সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই কিডনি সমস্যা থাকলে বাঁধাকপি বেশি খাওয়া শরীরের পক্ষে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবে পরিমিত পরিমাণে ও ডাক্তার নির্দেশিতভাবে খাওয়া যেতে পারে। 

গাজর (Carrot)

গাজরে পটাসিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। কিডনি সমস্যা থাকলে অতিরিক্ত পটাসিয়াম গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ কিডনি সঠিকভাবে পটাসিয়াম ফিল্টার করতে পারে না। তাই কিডনি রোগীদের গাজর পরিমিতভাবে খাওয়া উচিত। 

টমেটো (Tomato)

টমেটোতে পটাসিয়াম অনেক বেশি পরিমাণে থাকে, যা কিডনি রোগীদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত পটাসিয়াম কিডনির উপর চাপ বাড়ায় । কিডনি সমস্যা থাকলে টমেটো খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

আলু (Potato)

আলু পটাসিয়াম দ্বারা সমৃদ্ধ, যা কিডনি রোগীদের সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। বেশি পরিমাণে আলু খেলে কিডনি অতিরিক্ত চাপ নিতে পারে না। আলু সেদ্ধ করে খেলে কিছুটা পটাসিয়াম কমানো সম্ভব, তবে কিডনি সমস্যা থাকলে ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া জরুরী। 

কুমড়ো (Pumpkin)

কুমড়োতে ফসফরাস ও পটাসিয়ামের উপস্থিতি কিডনির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিডনি রোগীদের কুমড়ো খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অতিরিক্ত ফসফরাস শরীরের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে এবং কিডনির ওপর বাড়তি চাপ বাড়ায়। তাই, কুমড়ো সঠিক পরিমাণে ও ডাক্তারির পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া উচিত। 

লাউ (Bottle gourd)

লাউ সাধারণত স্বাস্থ্যকর সবজি হলেও কিডনি রোগীদের জন্য বেশি পরিমাণে খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। লাউ কিডনিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। কিডনি সমস্যা থাকলে লাউ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি এবং ডাক্তার নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। 

বেগুন (Eggplant) 

বেগুনে ফসফরাস ও পটাসিয়ামের উপস্থিতি কিডনি রোগীদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত ফসফরাস কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং সমস্যা দীর্ঘায়িত করে। কিডনি সমস্যা থাকলে বেগুন খাওয়ার পরিমাণ সীমিত রাখা জরুরি। পরিমিত খেলে সমস্যা হবে না, তবে ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশ্যক। 

শিম (Beans)

বিভিন্ন ধরনের শিমে পটাসিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ বেশি, যা কিডনি রোগীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বেশি শিম খেলে কিডনিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং কিডনির ক্ষতি হতে পারে। কিডনি রোগীরা শিম খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরী এবং ডাক্তার নির্দেশিত খাবার খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত। পরিমিত খাওয়া ভালো, অতিরিক্ত নয়।

শেষ কথা

কিডনি আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি রক্তকে পরিশোধন করে এবং বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি বের করতে সহায়ক।

কিডনির সামান্য সমস্যাও দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি, এটি ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের দূর গোঁড়ায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। তাই কিডনির ব্যাপারে বাড়তি  যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি।

যদি কিডনি রোগ ধরা পড়ে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য তালিকা ও ওষুধ গ্রহণ করা অপরিহার্য। কখনোই নিজের মতো করে ওষুধ খাওয়া বা খাদ্য পরিবর্তন করা উচিত নয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url